মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০২৪ সালে চাঁদে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা করছে যা পরবর্তীতে ২০৩০ সালের মঙ্গলগ্রহে মানব অভিযানকে ত্বরান্বিত করবে। চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহ অভিযান সম্ভব করতে প্রয়োজন মানব-চালিত রোভার।
সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে নাসা প্রত্যেক বছর আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজন করে আসছে এমন একটি প্রতিযোগিতা যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের সৃজনশীল মেধা কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গ্রহ বা উপগ্রহের জন্য একটি মানব-চালিত রোভারের থ্রি-ডি ডিজাইন, প্রোটোটাইপ তৈরি ও তা সফলভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পায়।
১৯৯৪ সাল থেকে এই প্রতিযোগিতা ‘গ্রেট মুনবাগি রেস’ নামে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৪ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘নাসা হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন রোভার চ্যালেঞ্জ’।
এই প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায়ও আনা হয় আমূল পরিবর্তন, টেস্ট গ্রাউন্ডে যোগ করা হয় মঙ্গল গ্রহের ন্যায় ভূখণ্ড ও ধাপে ধাপে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের দল যোগদান করার সুযোগ লাভ করে।
২০২১ সালের এ প্রতিযোগিতায় নাসার বাছাইকৃত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ২৩টি আন্তর্জাতিক দল ও ৩২টি আমেরিকান দল ৮টি দেশ ও ২২টি আমেরিকান অঙ্গরাজ্যকে প্রতিনিধিত্ব করার গৌরব অর্জন করে।
গবেষণার এ বৃহৎ কর্মযজ্ঞে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। বি এ সি ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টারের দল ‘টেন-ড্রিমার্স’ এ বছর বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার সুযোগ পায়।
টেন-ড্রিমার্সের ক্যাপ্টেন জাহিদ হাসান শোভন জানায়, ‘আমরা পুরো এক বছর মানব-চালিত রোভার নিয়ে গবেষণার পর নাসাতে ইন্টারন্যাশনাল টিম প্রপোজাল জমা দিয়েছিলাম। রাব্রিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন মানদণ্ডে নাসা এই প্রপোজালের মূল্যায়ন করে ২০২০ সালের নভেম্বরে আমাদের রোভারের ডিজাইন এ প্রতিযোগিতার জন্য উপযোগি বলে ঘোষণা করে ও আমরা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ লাভ করি।’
এটি কোনো সাধারণ অফ-রোড যান নয়। কলাপস্ট অবস্থায় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় সবদিকেই ৫ ফিট আয়তনের মধ্যে তৈরি করতে হয় এ বাহন। শুধু তাই নয়, এ যানটির ৫ ফিট আপহিল উঠার সক্ষমতা সহ সামনে-থেকে-পিছনে ও এক দিক-থেকে-অন্যদিক ৩০ ডিগ্রি ঢাল অতিক্রান্ত করার কার্যক্ষমতা থাকতে হয়। এছাড়া গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স হতে হয় ১২ ইঞ্চির বেশি ও টার্নিং রেডিয়াস ১৫ ফুটের কম।
টিমের নির্বাহী ডিজাইনার তামিম আল মাহিরের বক্তব্য অনুযায়ী এ মানব-চালিত রোভারের থ্রি-ডি ডিজাইনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ব্লেন্ডার ২.৮ সফটওয়্যার। মঙ্গলগ্রহ ও চাঁদের জন্য উপযোগি এই রোভারের ডিজাইন করতে সময় লেগেছে ১৮০ ঘণ্টা ও পর্যাপ্ত খুঁটিনাটি যোগ করায় ফাইল সাইজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৫ জিবি। ডিজাইন রিভিউ (ডিআর) প্রেজেন্টেশনে নাসার বিজ্ঞানীরা এমন চমক প্রদ ডিজাইনের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
অন্যদিকে, চলমান করোনা মহামারীর কারণে দলের মার্কেটিং বিভাগকে অর্থ যোগানের ব্যবস্থা করতে নানাবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাই, পিছিয়ে পড়ে কাজের অগ্রগতি।
অবশেষে, বি এ সি ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগের পাশে দাঁড়াতে প্রাথমিক কিছু আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। ঠিক তারপর থেকেই ‘বি এ সি ইউনিভার ১.০’ এর ৩ মাসের কাজ ১৫ দিনে করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।
‘নিশ্চয়ই দলের জন্য এটা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ’ জানিয়েছে ইনফরমেশন অফিসার সাল সাবিলা।
এখানেই শেষ নয়, করোনার কারণে বেগ পেতে হয়েছে প্রজেক্টের বিভিন্ন পার্টস সংগ্রহের সময়। সঠিক ওজন, আয়তন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে রোভার তৈরি করাটা ছিল যেন এক দুঃসহ বিষয়। ঠিক এমনটিই বল ছিলেন দলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ রায়হান।
করোনার প্রকোপ ঠেকাতে অ্যামেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এর পরামর্শ অনুযায়ী ও ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেটস এর নির্দেশে নাসা এই প্রতিযোগিতা নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের পরিবর্তে ভার্চুয়ালি আয়োজন করে। এপ্রিলের ৭ তারিখের মধ্যে ভিডিও আকারে রোভার প্রদর্শনের জন্য বলা হয়। কিন্তু এ সময় বাংলাদেশ দলকে আকস্মিক লকডাউন-নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়। পাশের দেশ ভারতের দল যেখানে মঙ্গলগ্রহের ন্যায় ভূখণ্ডে রোভার চালিয়ে পরীক্ষা করতে সক্ষম, সেখানে নানা জটিলতায় পিছিয়ে বাংলাদেশ। তবে হাল না ছাড়ার স্পৃহা ও শেষ পর্যন্ত রোভার প্রদর্শনের সক্ষমতা নাসা বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে। তাইতো, নাসার রোভার প্রতিযোগিতার অফিসিয়াল টুইটার ও ফেসবুক পেজ থেকে বাংলাদেশ দলকেও ফিচার করা হয়েছে।
সবশেষে, ১৬ এপ্রিল নাসা এ প্রতিযোগিতার ফলাফল জানায়। সারা বিশ্ব থেকে ৪৩টি ফাইনালিস্ট দলের মধ্যে বাংলাদেশ দল ‘টেন-ড্রিমার্স’ গ্লোবাল র্যাংক এ ১১তম অবস্থান অর্জন করে।
টেন-ড্রিমার্সের উপদেষ্টা এইচএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ‘২০২২ সালের জন্য দলটি কে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকারী-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশ যে একদিন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
Leave a Reply