উইমেন ডেস্ক : একটি বা দুটি নয়, ছয়টি জাতীয় পরিচয় পত্র জালিয়াতি করে একটি চক্র কয়েক কোটি টাকার জমি দখল নিতে যেয়ে প্রশাসনের জালে আটকে কারাবরণ করেছেন চক্রের কতিপয় সদস্য। এখনও অন্তরীণ আছেন কেউ কেউ। তবে ওই ঘটনার মুল হোতা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন এখনও। গোয়েন্দা সংস্থার নজর রয়েছে ওই মুল হোতার উপর। নজরে রেখেছেন তারা। তারপরও থেমে নেই কুষ্টিয়া শহরের ভুমি দস্যুদের দখলদারিত্ব। এবার রুপ পরিবর্তন করে সাধারণ জনসাধারণের জমি, বাড়ীর পাশাপাশি সরকারী কর্মকর্তার বাড়ী, জমি দখল করছেন জাল দলিল, জাল জাতীয় পরিচয় পত্র হুবহু নকল করে। জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবন দখলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে বলছেন অভিজ্ঞ মহল। শহরের চৌধুরী কওসের উদ্দিন আহমেদ সড়কস্থ জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবন দখলের দশ দিন অতিবাহিত হলেও রহস্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কার্যত তেমন পদক্ষেপ দেখেনি এলাকাবাসী। প্রকাশ্যে স্বশস্ত্র অবস্থায় দখল নেয়ার পর এখনও বহাল তবিয়তে দখলদার মুন্না আর এ ঘটনার অন্তরালে রয়েছেন এক প্রভাশালী নেতা দাবী একাধিক সুত্রের।
জানা যায়, গত ১১ এপ্রিল প্রকাশ্যে নছিমন, করিমন যোগে বাঁশ, টিন, বালি, সিমেন্টের খুটি নিয়ে হৈ চৈ করে কতিপয় ব্যক্তি রাতের আঁধারে দখল নেয় কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর বাসভবনসহ প্রায় ১৫ কোটি টাকার সম্পদ। সরকারী টাকায় নির্মিত পাকা দেয়াল ও সাইন বোর্ড ভেঙ্গে করগেট টিন দিয়ে ঘেরা এবং ভেতরে সিমেন্টের খুটি আর বাঁশ দিয়ে কথিত ঘরও নির্মাণ করে তারা। আদালতের রায় নিয়ে ওই চক্র সশস্ত্র অবস্থায় দখলে নিলেও সে সময় প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলী বা তার কোন প্রতিনিধি। আইনী প্রক্রিয়ায় বিষয়টির ফয়সালা করার প্রক্রিয়ায় আছেন তারা। আর দখলকৃত জমি কিনতে অগ্রিম ১০ লাখ টাকাও দিয়েছে কুষ্টিয়া মিরপুর পৌরমেয়র হাজী এনামুল হক এমন দাবী দখল দার মুন্নার। তবে মুঠোফোনে মেয়র এনামুল হাজীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি কোন জমি কিনতে কাউকে টাকা পয়সা দেয়নি। আমি ওই সব ঘটনার সাথে কোন ভাবেই জড়িতও না। তবে আমার প্রতিনিধি মিন্টু তার (মুন্না) ইলেকট্রিক দোকান থেকে মালামাল ক্রয় করে তার সঙ্গে মিন্টুর কোন যোগসুত্র থাকলে থাকতে পারে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
জানা যায়, ১৯৬২-৬৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নামে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর মৌজার ৭৯ শতাংশসহ সকল সম্পত্তি জমি অধিগ্রহন করে সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক কুষ্টিয়া। সেই থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বাসভবন হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে ওই স্থানটি। ২০২০ সালে নতুন করে নির্মিত হয় একটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরী। কিন্তু হঠাৎ করেই ওই প্রতিষ্ঠান দখলে নেয় একটি প্রভাবশালী চক্র। আদালতের রায় নিয়ে রাতের আঁধারে দখল করে প্রায় ১৫ কোটি টাকার মুল্যের ওই সম্পদ। কীভাবে সরকারী সম্পদ রাতের আঁধারে দখল করে তাতে সকলকে হতাশ করেছে।
আদালতের রায় সুত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালত কুষ্টিয়া সদর এর ২২১/২০১৭ দেওয়ানী মামলার ১৩/১২/২০২০ তারিখে রায় ডিগ্রী মূলে ও ওয়ারিশ অনুযায়ী উক্ত সম্পত্তির মালিক সুকুমার দাস ও অপূর্ব কুমার দাস। যার এস এ খতিয়ান ৪৮৫, ৪৯২, আর এস খতিয়ান নং ১৩৯৫, ১৩৯৫, এস এ দাগ নং ৬৫৩, ৬৫৪, আর এস দাগ নং ৪৭৪,৪৭৩ জমির পরিমান পয়েন্ট ৩৭১৯ একর এর মধ্যে পয়েন্ট ২৪ এবং পয়েন্ট ৪২৫৬ একরের মধ্যে পয়েন্ট ৪২ এর্ক। সর্ব মোট পয়েন্ট ৬৬ একর জমি আদালত থেকে রায় পেয়ে নিজেদের দখলে নিয়েছে তারা। এ বিষয়ে সুকুমার দাশ ও অপূর্ব দাশের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, উক্ত জমি ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে তাদের দপ্তরের নামে বরাদ্দ দেয় সরকার। তার পর থেকে উক্ত সম্পত্তির উপর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলীর দোতালা বাস ভবন, এসডির বাস ভবন তৈরী করে তারা সেখানে বসবান করে আসছে। বর্তমানে উক্ত জমির উপর দোতালা বিল্ডিং তৈরী করে পানি পরিক্ষাগার স্থাপনের কাজ চলামান। এই সম্পত্তির মূল্য কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকার বেশী। হঠাৎ করে একটি দূর্বৃত্ত চক্র ভুয়া দলিলের মাধ্যমে আদালত থেকে রায় নিয়ে এসে পয়েন্ট ৬৬ একর সম্পত্তি জোর পূর্বক দখল করে নিয়েছে। তারা আমাদের ওই সম্পত্তির উপর টিন দিয়ে ঘিরে নিজেদের দখলে নিয়েছে। এ ব্যাপারে ওই কর্মকর্তা বলেন, তারা কিসের বলে ওই সম্পত্তি দখলে নিল তা খতিয়ে দেখার জন্য জেলা প্রশাসনের দপ্তরে কাগজপত্রের সন্ধান নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও জানান, যেহেতু আমরা আইন অমান্য করতে পারি না। দখলকারীরা লাঠিশোঠা নিয়ে সংঘবদ্ধ ভাবে এসে আমাদের নামিয় দখলিয় সম্পত্তি জোর পূর্বক দখল করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা আইনের লড়াই চালিয়ে যাব।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবন ও পানি পরীক্ষাগারসহ ৬৬শতক জমি দূর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে দখল করে নেয়ায় সরকারী অফিস পাড়ায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুরের রহিম খার ছেলে তৌহিদুল ইসলাম মুন্নার নেতৃত্বে ওই দূর্বৃত্ত এ দখল নেয়। এই জমির বিষয়ে মুন্না বলেন, জমির মালিক হিন্দু সম্প্রদায় সুপ্রীতিবালা তার ওয়ারিশ দাবীদার সুকুমার দাস ও অপুর্ব কুমার দাস। তারা আদালত থেকে রায় ডিক্রি পাওয়ার পর তাকে আম মোক্তার নামা দিয়েছে বলে মুন্না জানিয়েছে। সে আরও জানায়, তিনি পেশায় একজন ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী। আগে ফেরি করে মালামাল বিক্রি করতেন। এখন পাঁচ রাস্তার মোড়ে চাঁদ সুপার মার্কেটে মেসার্স এস,আর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সেখানে বৈদ্যুতিক তার, লাইট খুচরা ও পাইকারী কেনাবেচা করেন। মুন্না জানায়, রায় ডিক্রি প্রাপ্ত অপুর্ব কুমার দাস ও সুকুমার দাস দীর্ঘদিন থেকে তার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্টানে আসা যাওয়া করতেন। আদালত থেকে ওই জমির রায় পাওয়ার পর তার দোকানে এসে জমিটি বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর ওই জমির কাগজ পত্র বিভিন্ন আইনজীবিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করিয়ে তার জমি বিক্রির উদ্যোগ নেন। এবং তাদের বেশ কিছু টাকা দিয়ে আম মোক্তার নামা গ্রহন করেন। এর পর মিরপুর পৌর মেয়র হাজী এনামুল তাকে অগ্রিম ১০ লাখ টাকা দিয়েছে জমি কিনতে। এ পর্যন্ত ওই জমির পেছনে তার প্রায় ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
এদিকে সরজমিনে পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের চৌধুরী কওসের উদ্দিন আহমেদ সড়কের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর বাসভবন এলাকায় গেলে দেখা যায়, বাসভবনের গেটের ডান পাশে নির্বাহী প্রকৌশলীর সাইনবোর্ডটি এখনও ভাঙ্গা এবং পাকা প্রাচীরের সাথে করগেট টিন দিয়ে ঘেরা প্রবেশ মুখে আম গাছের কাছে পাকা সিমেন্টের খুটি, বাঁশ দিয়ে একটি কথিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল তার সবই রয়েছে। ওই দিন দখল নেয়ার সময় পেছনে পানি পরীক্ষাগারের বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছিল। ওই সকল মিস্ত্রির সামনেই দখলদাররা টিন দিয়ে ঘিরতে গেলে তারা বাধা দেয় পরে তারা ওই স্থান থেকে প্রধান ফাটকের সামনে দেয়ালে টিন লাগিয়ে দখল দৃশ্য করছে।
একটি দায়িত্বশীল সুত্র বলছে, এর পেছনে স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ইন্ধনে একজন সরকারী কর্মকর্তার বাসভবনে এমন দখলবাজ দেখানো যায়। একজন ফেরিওয়ালা কিভাবে কোন ক্ষমতার বলে একজন সরকারী কর্মকর্তার বাসভবন প্রকাশ্যে দখল নিতে পারে তা কারো বোধগোম্য নয়। এলাকাবাসী বলছেন, আগে যেখানে ভেতরে প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নেয়া লাগতো আম পাড়লে পুলিশ এসে তাড়া করতো স্থানীয়দের। এখন প্রকাশ্যে হৈ চৈ করে বাঁশ-খুটি নিয়ে ওই সরকারী বাড়ী দখল করে ভেতরে ঘর নির্মাণ করার দশদিন অতিবাহিত হলো এখন পর্যন্ত রহস্যজনক ভাবে কর্তৃপক্ষের কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সুত্র বলছে, প্রতিদিন দখলদার মুন্না পাঁচ রাস্তার মোড়স্থ চাঁদ সুপার মার্কেটের নিজ দোকানে বসে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে খোশ গল্প করে বহাল তবিয়তে আছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর বেশ কিছু জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে গত কয়েকদিন আগে নির্বাহী প্রকৌশলী পুলিশের একটি টিম নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে এ ব্যাপারে দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন কিনা সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছিলেন বেআইনীভাবে একটি চক্র ভূয়া কাগজ দেখিয়ে দখলে নিয়েছে। আইনগতভাবে এর ফয়সালা করা হবে।
কুষ্টিয়া জজ কোর্টের জিপি এ্যাডঃ আ স ম আখতারুজ্জামান মাসুম জানিয়েছিলেন, অবৈধ প্রক্রিয়ায় একটি চক্র সরকারী সম্পদ দখলে নিয়েছে। বিষয়টি আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবে। এদিকে এখন পর্যন্ত কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহন এলাকাবাসীর চোখে পড়েনি বরং ভেতরে দখলকৃত জমির ভাগ-বাটোয়ারা চলছে বলে জানা গেছে।
Leave a Reply