ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহীনি ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে নিহত শহীদদের স্বীকৃতি না মিললেও কুখ্যাত রাজাকারের নামে গ্রামের নাম, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকঘর ও সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।
দেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পার হলেও শহীদদের স্মরণে বোয়ালমারীতে আজও নির্মিত হয়নি কোনা স্মৃতিসৌধ, নামকরণ করা হয়নি কোনো সড়কের। এখানকার বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত, কোথাও কোথাও চরম অবহেলিত শহীদদের গণকবর! কবরের ওপরই গড়ে তোলা হয়েছে শৌচাগার।
অথচ বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের একাংশের নামকরণ করা হয়েছে কুখ্যাত রাজাকার এমএ ওয়াহিদ টিপু মিয়ার নামে। তৎকালীন শান্তি কমিটির সভাপতি টিপু মিয়া এবং তার ছেলে কুখ্যাত রাজাকার জাহাঙ্গীর বারী কোটন অসংখ্য স্বাধীনতাকামীর হত্যাকারী। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো জঘন্য কাজ ছিল না, যা টিপু মিয়ার মদদে তার ছেলে কোটন করেনি।
অত্যাচারী এমএ ওয়াহিদ টিপু মিয়া ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট থেকে পি ই ফরিদপুর ২০৪-এর প্রাদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় নিজে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের জমিদার মহাদেব সাহার বাড়ি দখল করে নেন, দখল করেন ফরিদপুর সদরের একটি বিল্ডিং (দেশ ক্লিনিক) এবং বালিয়াকান্দি পদমদী জমিদার বাড়ি। পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে এই কুখ্যাত রাজাকার বোয়ালমারী সদর ইউনিয়েনের সৈয়দপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে ওয়াহিদাবাদ নামকরণ করিয়ে নেন। সেই সঙ্গে ওয়াহিদাবাদ ত্রিপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়াহিদাবাদ ডাকঘর, ইসলামিক মিশন হাসপাতাল ওয়াহিদাবাদ- কুখ্যাত এ রাজাকারের নাম সংযুক্ত হয়ে যায়।
গ্রাম, ডাকঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনায় রাজাকার টিপু মিয়ার নাম শোভাবর্ধন করলেও, স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীকে সম্মানিত করা হলেও শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা আজও উপেক্ষিত।
এলাকার প্রবীণ রাজনীতিবিদ, ঘোষপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলাউদ্দীন আহমেদ মিয়া বলেন, টিপু মিয়া, কোটন, তৎকালীন কয়েকজন চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রভাবশালী দু-একজন রাজাকারের সহযোগিতা না থাকলে পাকিস্তানি আর্মি বোয়ালমারীতে ঢুকে গণহত্যা চালানোর সাহসই পেত না। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানি আর্মিদের চেয়ে টিপু মিয়া, কোটন, বাচ্চু রাজাকার মানুষের ওপর বেশি অত্যাচার এবং গণহত্যা চালিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, আমাদের একাত্তরের চেতনার ঘাটতির কারণেই টিপু মিয়ার নামে গ্রামের নামাঙ্কিত (ওয়াহিদাবাদ) সাইনবোর্ড ইসলামিক মিশনের গায়ে শোভা পাচ্ছে। তিনি অবিলম্বে ওয়াহিদাবাদ গ্রাম, ডাকঘর ও রাজাকারদের নামে যেসব স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে, তা বদল করে বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণের দাবি জানান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুর রউফ সিদ্দিকী আক্ষেপ করে বলেন- বোয়ালমারীতে গণকবর সংরক্ষিত না হলেও, শহীদদের স্বীকৃতি না মিললেও এম. এ. ওয়াহিদ টিপু মিয়ার নামানুসারে নামাঙ্কিত গ্রামের নামফলক শহীদদের, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের টিপ্পনী কেটে হাসছে। অচিরেই এই নাম মুছে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বীর শহীদ অথবা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হোক।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ বলেন, বোয়ালমারী পৌর সদরের কলেজ রোডের গণকবরটির সংরক্ষণ, স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের জন্য একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া হাসামদিয়, রামনগর ও গোহাইবাড়ির গণকবরগুলো আমি পরিদর্শন করেছি। সেগুলোকে চিহ্নিত করে প্রাথমিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে গণকবরগুলো সংরক্ষণে বড় ধরনের কর্মপরিকল্পনা রয়েছে এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের নামে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেগুলো নাম পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ব্যক্তিদের নামে নামকরণ করা হবে।
Leave a Reply